অশরীরি





পাশের গ্রামের বজ্রপাতে ছেলেটা মরবার পর থেকেই কালু কাকা লাশ চুরির সুযোগ খুঁজছে। কয়েকদিন রাতে লাশটা চুরি করতে গিয়েও বারবার ঘুরে আসতে হয়েছে। কয়েক রাত কবরস্থানে চুপিচুপি বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। একটু পরপর একজন না একজন এসে কবর পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। অবস্থা এমন যে সেখানে কবর না কোনো হিরের খনি পাহারা দেওয়া হচ্ছে ।
কালু কাকা কবিরাজ। ছোটবেলা থেকে এসব ভূতপ্রেত নিয়ে ঘাটাঘাটি করার অভ্যাস। খুব অল্পবয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে কোন এক সন্ন্যাসীর সাথে আট বছর কাটিয়ে তারপর বাড়ি ফিরেছে। বিয়েশাদী করেনি। একবার প্রশ্নও করেছিলাম, কাকা বিয়ে শাদী করবে না?কালু কাকা উত্তর দিয়েছিল, কবিরাজদের বিয়ে করলে ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
ছেলেটার মরার খবর শুনবার পর থেকেই কালু কাকা সব রকম চেষ্টা করছে লাশটা সংগ্রহ করার। এসব লাশ দিয়ে নাকি অসাধ্য সাধন করা যায়। বিশেষত লাশের মুণ্ডু দিয়ে দুনিয়াতে এমন কিছু নাই যেটা করা যায় না। ছেলেটার বয়স, মরবার দিন, সব মিলে লাশটা একদম মন্ত্রসাধনা করার জন্য উপযুক্ত।
অবশেষে এলো সেই সুযোগ। 
আষাঢ় মাস, সন্ধেবেলা থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি পরছে। সম্পূর্ণ আকাশ কয়লা কালো হয়ে আছে। বিদ্যুৎ চমকানোর আলো ছাড়া অন্ধকারে নিজের হাতকেও দেখা যায় না। এমন সময় আমি আর কালু কাকা পাশের গ্রামের ভিটের কবরস্থানের দিকে রওনা হলাম।
গ্রামের রাস্তা, কাদা আর বৃষ্টির পানিতে কাদা মাখামাখি হয়ে আছে। রাস্তা দিয়ে না গিয়ে গ্রামের মাঠ দিয়ে পাশের গ্রামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার হাতে একটা বাঁশের লাঠি আর কালু কাকার হাতে রয়েছে বিশাল এক রামদা। মনে মনে খুব ভয় পাচ্ছিলাম। যদি উল্টাপাল্টা কিছু হয়ে যায়! একহাঁটু পানির মধ্যে দিয়ে দুজন এগিয়ে যাচ্ছি। চারপাশে পানির উপর বৃষ্টির শব্দের থেকে আমাদের পানি ভেঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার শব্দ বেশি করে কানে ভেসে আসছিল। মাঝেমাঝে মনে হচ্ছিল আমাদের পিছনেও কে যেন পানির মধ্যে দিয়ে আমাদের অনুসরণ করছে। বারকয়েক পিছু ফিরে তাকিয়েও তার অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না।
যখন কবরস্থানে পৌঁছালাম তখন প্রায় গভীর রাত। কালু কাকা হাতের রামদা আমার হাতে দিয়ে লুঙ্গির গিঁট বাঁধতে গিয়ে বলল "বলে ছিলাম না, এই তীব্র বর্ষার রাতে কেউ কবর পাহারা দিবে না। গিয়ে দেখ একেকটা বাড়ির মধ্যে কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে"। এসব বলেই কালু কাকা হা হা হা করে হেসে উঠলো।
কবরস্থানে গভীর রাতে কালু কাকার হাসি খুব অপার্থিব হয়ে বুকের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধতে লাগলো।
কালু কাকা আমার হাত থেকে রামদা নিয়ে বলল " তুই এখানে দাঁড়িয়ে থাক। ভয় পাসনে। এই কাজ আমি এর আগেও একবার গুরুর সাথে করেছি। এই যাবো আর লাশের মুন্ডু নিয়ে ফিরে আসবো"।
রাতের কাক কালো অন্ধকার আর তুমুল বৃষ্টির মধ্যে একা একা নির্জন একটা কবর স্থানের পাশে দাঁড়িয়ে কালু কাকার চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে রইলাম।
মাঝেমধ্যে কাক কালো আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সেই আলোতে দেখছিলাম কালু কাকা একটু একটু দূরে সরে যাচ্ছে।
আশেপাশে কোথাও খুব জোরে একটা বজ্রপাত হলো। অবস্থা এমন যে কিছুক্ষণ নিজের কানে আর কিছু শুনতে পেলাম না। হঠাৎ করে বৃষ্টি থেমে গেলো। কিন্তু আকাশে তখন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এমন সময় দেখি কালু কাকা পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে।
বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে হঠাৎ কালু কাকা কে দেখে কলিজা হিম হয়ে গেলো। কাকা বলে উঠলো "তোকে কখন থেকে ডাকছি? শুনতে পাসনি? আয় আমার সাথে আয়"।
চুপিচুপি কালু কাকার পিছনে হাঁটা শুরু করলাম। তারপর হঠাৎ করে কালু কাকাকে থামতে দেখে নিজেও থেমে গেলাম। চোখের সামনে দেখলাম একটা নতুন কবর। চারদিকে বাঁশের বেড়া দেওয়া।
কালু কাকা আমার পায়ের কাছের মাটিতে রামদা রেখে কবরের বেড়ার একটা বাঁধন খুলে কবরের মাটি সরাতে লাগলো। দু এক মিনিট পরেই নাকে ভেসে এলো মরার পঁচা গন্ধ। কালু কাকা বলল "নাক চেপে ধর নাহলে বমি করে ফেলবি"। আমার গায়ের গেঞ্জি দিয়ে নাক চেপে ধরে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় কালু কাকার মাটি খোঁড়া দেখতে লাগলাম।
একটু পরেই কালু কাকা হাত দিয়ে মরার মাথা ধরে উপরে তুলতে লাগলো। কয়েকদিনের মরা, মুখের চামড়া নরম হয়ে খুলে মাথায় এসে জড়ো হলো। মুখে শুধু লেগে আছে গলিত মাংস। কাকা লাশটা উপরে তুলে মাটিতে শুইয়ে দিলো। তারপর রামদা দিয়ে যেইনা মুন্ডুতে কোপ দিবে ঠিক তখনি লাশটা দাঁড়িয়ে কালু কাকার গলা টিপে ধরল। ঠাশ ঠাশ করে চারপাশে অসংখ্য বজ্রপাত পড়তে লাগলো। এই সময় কালু কাকা চিৎকার করে বলে উঠলো, রানা তুই পালিয়ে যা। খবরদার পিছন ফিরে তাকাস না। আমার দিব্যি দিলাম তুই পালিয়ে যা।
কাকার কথা শুনে হাতের লাঠি ফেলে দিয়ে গ্রামের সীমানার দিকে দৌড় দিলাম। পিছন থেকে শুনতে পেলাম কালু কাকার চিৎকার। সেই সাথে একটা পৈশাচিক হাসি। মাঠের মধ্যে হাঁটু পানি দিয়ে দৌঁড়ানোর সময় মনে হচ্ছিল চারপাশ থেকে অসংখ্য অশরীরী আমার দিকে ছুঁটে আসছিল। বারবার কানে তাদের পানির মধ্যে ছুঁটে আসার শব্দ ভেসে আসছিল। সেইসাথে কবরস্থানে শোনা সেই অশরীরীর কলিজা হিম করা হাসি।
গ্রামের সব থেকে কাছের একটা বাড়ির দরজাতে কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে জ্ঞান হারালাম। পরদিন সকালবেলা জ্ঞান ফিরলে শুনলাম "কালু কাকা আর নেই। পাশের গ্রামের কবরস্থানে কে যেন রামদা দিয়ে তার মুন্ডু আলাদা করে দিয়েছে"।

4 comments:

Powered by Blogger.