পিশাচ




তখন গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম নতুন ভাবিকে দেখতে। আমার জেঠাতো ভাই এক মাস হয়েছে বিয়ে করেছে। আমার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর। গ্রামের কাউকে না জানিয়েই সেখানে গেলাম ভাইয়াই কে হঠাৎ সারপ্রাইজড করে দিতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমি নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম। গিয়ে জানতে পারলাম, ভাইয়া আর ভাবি নাকি ভাবির বাবার বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। তো আমি এসেছি এটা শুনে ভাইয়া কল করে বলল সরাসরি ভাবির বাড়িতেই চলে যেতে। ভাবির বাড়িটা দাদার বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে না। আধা ঘন্টা রিক্সার পথ। দাদা আর দাদি মারা যাওয়ার পর খুব একটা গ্রামে আসা হয়নি। তাই গ্রামের রাস্তা রিক্সা দিয়ে যেতে খুব একটা খারাপ লাগল না। সেখানে পৌঁছে ভাইয়া আর ভাবি দুজনের সাথেই বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। নতুন কুটুম বলে, আপ্রায়ণের কোন কমতি রাখল না তারা। ভাবির সাথেও বেশ ভাব হয়ে গেল। আমিও এইবার ইন্টার মিডিয়েট দিলাম। ভাবিও এই বছরেই দিল। যদিও গ্রামের মেয়েরা একটু বেশি বয়সেই লেখাপড়া করে। তাই ভাবী আমার চেয়ে বয়সে ২-৩ বছরের বড়ই হবেন। তবে আসল কথা এটা নয়। . সেদিনই সন্ধায় ঐ বাড়ির সকলে মিলে বাড়ির উঠানে আড্ডায় বসলাম। পিঠার আসর বসেছিল। সবাই পিঠা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এরমধ্যে হঠাৎ ভাবির দাদা এসে আমাদের আড্ডাটা আর মজিয়ে তুলল। আমাদের নানান রকমের অদ্ভুত গল্প শোনাতে থাকলেন তিনি। গল্পগুলো বেশ মজার ছিল। আমরা সবাই ই হাহা করে হাসছিলাম। তবে আমি মনে হয় একটু বেশিই মজা পাচ্ছিলাম আর জোরে জোরে হাসছিলাম। তাই একটা বাচ্চা মেয়ে সবার সামনে জোরেই বলে ফেলল, এই ভাইয়াটা খালি পিশাচের মতো হাসে। বাচ্চা মেয়েটার মিষ্টি কন্ঠে হঠাৎ এইরকম কথা শুনে সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করল। আমি বেশ লজ্জা পেয়ে গেলাম। তাই প্রসঙ্গটা পাল্টাতে আমিই দাদুকে প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা দাদু, তোমাদের এইখানে সবাই কথায় কথায় পিশাচ শব্দটা উচ্চারণ করে কেন? তোমরা কী খুব একটা পিশাচে বিশ্বাস কর? পিশাচের গল্প শুনেছ? পিশাচ কেমনে হাসে? আমার প্রশ্নটা শুনে দাদুর মুখটা বেশ গম্ভীর হয়ে গেল। তার মুখে যেন ভয়ের ছাপ দেখতে পেলাম। এরপর দাদু আমাকে লক্ষ্য করে বলল, পিশাচের গল্প শুনব কী রে দাদু ভাই, আমিতো নিজের চোখেই পিশাচ দেখেছিলাম। দাদু কথাটা শেষ করতেই আড্ডায় বসে থাকা বাচ্চা ছেলেমেয়ে সহ প্রায় সবাই ই উঠে ঘরে চলে গেল। বুঝলাম ভুতের গল্পে এখনো এরা ভয় পায়। দাদুর সামনে বসে রইলাম শুধু আমি ভাবি আর ভাইয়া। দাদু একটু মুচকি হেসে তার গল্পটা বলা শুরু করল। দাদুর ভাষায় গল্পটা: . "তখন আমার বয়স ১৩ কিংবা ১৪ বছর। প্রতি রাতের মতো একরাতে আমি ঘুমাতে যাব। রাত তখন প্রায় ১১টা বাজে। আমি আর আমার এক কাকা একটা ঘরে থাকতাম। কাকা সেদিন আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তো আমি যেই ঘুমাতে যাব, হঠাৎ ঘরের বাহিরে কয়েকটা হাঁসের পেকপেক ডাক শুনতে পেলাম। তখন আমার মা আবার, হাঁস পালতো। তো আমি ভাবলাম হয়তো মা সন্ধ্যায় হাঁসের ঘরের দরজা আটকাতে ভুলে গেছে। তাই ঘর থেকে বের হলাম হাঁসগুলোকে ধরে খাঁচায় আটকাতে। ঘর থেকে বের হতেই দেখলাম ৩টা সাদা হাঁস উঠানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাঁসগুলো দেখতে বেশ অদ্ভুত। চোখগুলো জ্বলজ্বল করছিল। আমি হাঁসগুলোকে দেখেই বুঝতে পারলাম, এই হাঁসগুলো আমাদের হাঁস না। হয়তো অন্য কারো হাঁস। কিন্তু এ গ্রামে এইরকম এত সাদা হাঁস এর আগে আমি কখনই দেখিনি। কিন্তু হাঁসগুলো এতরাতে আমাদের বাড়িতে এল কিভাবে? ভাবতে লাগলাম। এরপর কেনো জানি আমি হাঁসগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে থাকি হাঁসগুলোকে ধরতে। হাসগুলো আমাকে দেখেই উল্টো দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল। তবে খুব ধীর গতিতে। এইরকম ভাবে হাঁটতে এর আগে আমি কোন হাঁসকেই দেখিনি। আমার খুব ভয় লাগছিল। তাও আমি কেনো জানি হাঁসগুলোকে অনুসরণ করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। হাসগুলো আমাকে আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দুরের একটা বড় গর্তের সামনে নিয়ে আসে। এটি একটি অনেক পুরাতন গর্ত ছিল, কিন্তু বেশ গভীর। এই গর্তের চারিদিকে কোন দেয়াল দেওয়া ছিল না। তাই বেশ বিপদজনকও বটে। এই গর্তে আমরা এবং আমাদের প্রতিবেশিরা ময়লা আবর্জনা ফেলতাম। তো হাঁসগুলোর গর্তটার দিকে এগিয়ে যাওয়াটা দেখে আমি বেশ অবাক হয়ে যাই। কিছুটা দূরেই থমকে দাঁড়িয়ে থাকি। এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে হাঁসগুলো দ্রুত সেই গর্তে লাফিয়ে পড়ে। আমি ঘটনাটা দেখে ভয়ে আঁতকে উঠি। ভয় পেয়ে আবার আমার ঘরের দিকে ছুটি। ঘরের দরজাটা খোলা রেখেই এইদিকে চলে এসেছিলাম। অবাক হলাম এটা দেখে যে, আমার ঘরের সামনে একটা ৭-৮ বছরের বাচ্চা ছেলে জামা-কাপড় ছাড়া ন্যাংটা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুর থেকে ছেলেটাকে চিনতে পারছিলাম না। তবে বুঝতে পারছিলাম যে, ছেলেটা আমার দিকেই তাক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে রয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে ঘরের সামনে ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেলাম। তখন ছেলেটাকে ভালোমতোই চিনতে পারলাম। আরে এটাতো করিম। আমাদের তিন বাড়ি পর ওদের বাড়ি। কিন্তু গত ২ দিন ধরে ও নিখোঁজ ছিল। কোথাও ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই এতরাতে ওকে এখানে দেখে বেশ অবাকই হয়েছিলাম। করিম কে দেখতেও বেশ অন্যরকম লাগছিল। জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল তার দুটি চোখ। কী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সে আমার দিকে! এছাড়া তার শরীর থেকেও বেশ পঁচা আর এটোঁ গন্ধ আসছিল। মনে হচ্ছিল ময়লা স্তুপ থেকে উঠে এসেছে। আমি বেশ অবাক হয়েই ছেলেটাকে প্রশ্ন করি, কী রে করিম? এই দুইদিন কই ছিলি? আর ন্যাংটা হইয়া এতরাইতে এইখানে কী করছ? করিম আমার কথার কোন উত্তর দেয় না। শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপরেই আমি আবার পেছনে সেই হাঁসের পেকপেক ডাক শুনতে পাই। পেছনে ফিরে দেখি সেই ৩টা হাসই করিমের দিকে ছুটে আসছে। করিমও হাঁসগুলোর দিকে ছুটে যাচ্ছে। এরপর করিম যা করল, তা আমি স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারিনি। করিম একটা হাসের গলা চেপে ধরে মেরে ফেলল আর হাসটাকে কাচাই ছিড়ে ছিড়ে খেতে লাগল। এটা দেখেতো আমি ভয়ে শেষ। পরক্ষণেই করিম বাকি দুটো হাসকেও কাচা চিবিয়ে গেল। এক ফোটা রক্তও পরে রইল না উঠানে। এরপর করিম সেই গর্তের দিকে ছুটতে লাগল। আমি ভয়ে পালাতে চাইলাম, চিৎকার করতে চাইলাম। কিন্তু কেনো জানি পালাতে পারলাম না। আমিও কোন এক অদৃশ্য মায়ার টানে করিমের পিছু পিছু ছুটতে লাগলাম। করিমের শরীরের মাংসগুলো যেনো গলে, খুলে খুলে পড়ছিল। আমার ভয় লাগছিল তাও আমি তার পেছনে ছুটছিলাম। আমি পালাতে চাচ্ছিলাম কিন্তু পারছিলাম না। করিম অবশেষে গর্তের সামনে গিয়ে থামলো। আমিও তার থেকে বেশ কিছুটা দূরে থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম। তখনও আমি তার অর্ধগলা শরীরটা দেখতে পারছিলাম। এরপর করিম মুহূর্তেই লাফিয়ে পড়লো সেই গর্তে । আমি ভয়ে জোরে একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। জ্ঞান ফিরলো আমার পরেরদিন সকালে। প্রচন্ড জ্বর আর মাথা ব্যথা নিয়ে। আমার চারপাশে তখন আমার আত্মীয়স্বজনেরা দাড়িয়ে ছিল। আমি তাদের গতরাতের পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম। কিন্তু তারা আমার কথাটাকে বিশ্বাস করল না। নেহাত ছেলেমানুষী ভেবে উড়িয়ে দিল। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলাম যে, সেদিনও করিমকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অবশ্যি ঘটনাটা শুধু আমার সাথেই ঘটেনি। আমাদের আশেপাশের কয়েকটা প্রতিবেশীরাও এই ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল। তারাও ন্যাংটা করিম আর ৩টা হাসকে সেই গর্তে লাফিয়ে পড়তে দেখেছিল আলাদা আলাদা রাত্রে। এরপর সবার ধারণা হয় যে, করিম হয়তো হারিয়ে যায়নি। খেলতে খেলতে এই গর্তে এসে পড়ে, মারা গিয়েছে। তাই তার আত্মা শান্তি পায়নি। আর পিশাচ হয়ে গেছে। তাই এখন সে, হাঁস মেরে খায়। সন্দেহের বসে সবাই মিলে লোক আনিয়ে সেই গর্তটাকে খুড়াঁয়। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে আসলেই গর্তে করিমের অর্ধপচাঁ লাশটা পাওয়া যায়। সবাই ঘটনাটা দেখে বেশ অবাক হয়। আর করিমকে পিশাচ জীবন থেকে মুক্তি দিতে তার লাশের জানাজা পড়িয়ে দাফন দেওয়া হয়। সেই গর্তটাকেও চিরোতরে মাটি দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে আর কেউ করিম বা সেই ৩টা হাঁসকে কোনদিন দেখেনি। এখন অবশ্য এই ঘটনা অনেকের মনেও নেই।" . . দাদুর মুখে পুরো ঘটনাটা শুনে আমরা ৩ জনে কয়েক বার ভয়ে শিহরিয়ে উঠেছিলাম। এরপর যে যার ঘরে চলে গেলাম। ভাইয়া আর ভাবিকে আলাদা ঘর দেওয়া হয়। আমাকেও একটা আলাদা ঘর দেওয়া হয় ঘুমানোর জন্য। অবশ্য সেরাত পুরোটাই আমার কাটে নির্ঘুম অবস্হায়। ঘটনাটা শুনে এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে, সারারাত মনে হয়েছিল ঘরের বাহিরে হাঁস পেকপেক করে ডাকছে আর আমার চারপাশে একটা ৭-৮ বছর বয়সের ছেলে ন্যাংটা হয়ে ঘুরছে। সকাল বেলা মাথা ব্যথা আর জ্বরে চোখই খুলতে পারছিলাম না। ডাক্তার বলেছিল জ্বর ১০৪°। সেরাতে বুঝেছিলাম, রাতে ভুতের গল্প শোনার মজা। পরেরদিনই জ্বরের কারণে ভাইয়া আমাকে আবার শহরে পাঠিয়ে দেয়।।

No comments

Powered by Blogger.